১৯ নভেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবস। উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রায় পিছিয়ে নেই এ দেশের নারীরাও। বিশেষ করে প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক নারীই এখন ঘরে বসে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। নিজে কিছু করার স্বপ্ন থেকে কেউ যুক্ত হয়েছেন রন্ধনশিল্পের সঙ্গে। নানা পদের রান্নার রেসিপি দিয়ে আয় করছেন ঘরে বসে। আবার বিদেশের অভিজ্ঞতায় কেউ গড়ে তুলেছেন ভাগাভাগির অফিস বা কার্যালয় ব্যবসা। কেউ তৈরি করেছেন প্রশিক্ষণকেন্দ্র। আবার ঘরে বসেই মসলার জনপ্রিয় ব্র্যান্ডও তৈরি করে ফেলেছেন একজন। চার নারীর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে এবারের আয়োজন।

বাবার বদলি চাকরির কারণে বগুড়ার মেয়ে রুমানার জন্ম ঠাকুরগাঁওয়ে। তবে কোথাও দীর্ঘদিন থাকা হয়নি তাঁর। দেশের নানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন মা–বাবার সঙ্গে। তবে অন্য ১০ জনের সঙ্গে রুমানার পার্থক্য ভিন্ন। বাড়ির সবাই খেতে বেশ পছন্দ করেন। তাই তাঁদের বাড়ির পুরুষেরাও রান্না করতেন নিয়মিত। রুমানারও অনেক সময় কাটত রান্নাঘরে। বন্ধুরা যখন নতুন জামা, নতুন বই কিংবা নতুন সিনেমার কথা বলে, তখন রুমানার জগৎজুড়ে থাকে শুধু নতুন নতুন পদের রান্না, নতুন এলাকা, নতুন খাবার। রুমানার নোট বইয়ের পাতা ভরে ওঠে নিত্যনতুন রেসিপিতে। মা–বাবার উৎসাহে চলে নিজের নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিয়ের পর রুমানা আবিষ্কার করেন, তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও ভোজনরসিক। সেখানে বিভিন্ন উৎসবে ছেলেরাই বাবুর্চির কাজ করে। এর মধ্যে খেয়াল করি, প্রথম আলোতে প্রতি মঙ্গলবার বের হয় ‘নকশা’। সেখানেও রান্নার বিভিন্ন পদের রেসিপি থাকে। রুমানা বলেন, ‘সেই রেসিপির সঙ্গে আমার নোট বইয়ের রেসিপি মিলিয়ে নিই। নতুন ফিউশনও করি।’ এভাবে দুই পরিবারের উৎসাহে রুমানার রন্ধনশিল্পের পথে যাত্রা এগিয়ে চলে।

আলাপকালে রুমানার স্বামী অমি আজাদ বলেন, ‘আমি একদিন বললাম, তোমার রান্নাবান্নার যাবতীয় তথ্য অনলাইনে আর্কাইভ করে ফেলতে পারো।’ ২০১২ সালে ইউটিউব তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। তাই স্বামীর পরামর্শে ব্লগে লেখার কথা ভাবলেন রুমানা আজাদ। পরে মনে হলো, শুধু লিখে কি বোঝানো যাবে সব? তাই ঠিক করা হলো, রান্নার পাশাপাশি ভিডিও তৈরি করা হবে। যেখানে বিস্তারিতভাবে ওই পদ বানিয়ে দেখানো হবে। আমরা খুব উৎসাহ দিলাম। রান্নার পর ওই খাবার খাওয়ার জন্য তো কাউকে লাগবে—হাসতে হাসতে বললেন রুমানার স্বামী।

তারপর ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম ভিডিও প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম ডেইলি মোশনে ভিডিও অবমুক্ত করলেন রুমানা। বাসায় যে ক্যামেরা ছিল, সেটা দিয়েই শুরু। সেই সময় ইউটিউব থেকে টাকা আয়ের কোনো ধারণা ছিল না রুমানার। এমনকি বাংলাদেশ থেকে ইউটিউবে চ্যানেল খোলাটাও সহজ ছিল না। তাই রুমানার রান্নাবান্নার চ্যানেল খোলা হয়েছিল সিঙ্গাপুরপ্রবাসী এক বন্ধুর ঠিকানা ব্যবহার করে। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইউটিউবের পার্টনার প্রতিষ্ঠান মিডিয়াকর্প সিঙ্গাপুর থেকে রুমানার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা জানায়, ‘ইউটিউব থেকে রোজগারের সুযোগ আছে।’ পরে এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরে আয়োজিত কয়েকটি কর্মশালায় অংশ নেন রুমানা। তারপরই ইউটিউব থেকে তাঁর রোজগার শুরু হয়। আর ২০২০ সাল থেকে ফেসবুক পেজ থেকে আয় শুরু করেন তিনি। বর্তমানে এই দুই চ্যানেল থেকে ভালো অঙ্কের টাকা রোজগার করেন রুমানা।

শুধু ইউটিউব ও ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীল থাকা ঠিক? এমন প্রশ্নের জবাবে রুমানা বলেন, ইউটিউব ও ফেসবুক–নির্ভরতার কারণ, শুধু ভিউর ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে অহেতুক ও যেনতেনভাবে ভিডিও তৈরি করার ঝোঁকও বাড়ে।’

এ জন্য ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন দেশি ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছেন রুমানা। মার্কস দুধ, রুপচাঁদা তেল, প্রাণ অ্যাগ্রো, এসিআই মসলা, আড়ং ডেইরির মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করছেন। ইউটিউব/ফেসবুকের আয়ের পাশাপাশি এগুলো এখন তাঁর আয়ের উৎস।

প্রযুক্তির কল্যাণে রুমানার মতো সৃজনশীল নারীদের নানা সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তবে তা থেকে নিজের আয়রোজগার করতে হলে নৈতিকতা বাদ দিয়ে ভিউ বাড়ানোর কাজে নামলে হবে না। মানসম্মত কনটেন্ট লাগবে বলে মনে করেন রুমানা। তিনি বলেন, ‘ইউটিউব থেকে প্রথম রোজগার পেতে আমার দুই বছর আর ফেসবুক থেকে প্রথম আয়ের জন্য এক বছর অনেক ভিডিও তৈরি করে প্রকাশ করতে হয়েছে।’

রুমানার ইউটিউব চ্যানেলে এখন ১৩ লক্ষাধিক দর্শক আছেন এবং তাঁর ৬৫০টি ভিডিও এ পর্যন্ত ১৭ কোটি বারের বেশি দেখা হয়েছে। তাঁর চ্যানেলটি পেয়েছে গোল্ড বাটন।

নিত্যদিনের দায়িত্বের পাশাপাশি নানা রকম রেসিপি সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং বিভিন্ন খাবার বা খাবারসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য মানসম্মত ভিডিও নির্মাণের কাজ চালিয়ে নিতে চান রুমানা আজাদ।